রিকশা-চালকের বাণী: “আসল বাড়ি তো ভাই এই দুনিয়ায় না”


রিকশায় উঠলে মনে হয় আমার গল্পটা বেড়ে যায়। না, অন্য কারো সাথে নয়, খোদ রিকশা-চালকের সাথে। অনেকে হয়ত ভ্রূ কোঁচকাবেন, কিংবা, নাক ছিটকাবেন। বলবেন, রিকশা-চালকের সাথে গল্প!? সে তো শুধু মার খাওয়ার আর গাল খাওয়ার লোক!! তার সাথে গল্প!! ডিজগাসটিং..!! তা বলতে পারেন, আমি বরং চুপ থাকি।

এই অভ্যাসটা আমার একজন প্রিয় শিক্ষক থেকে পাওয়া। তিনি যে কোনো রিকশা/ট্যাক্সি/সি.এন.জিতেই ওঠেন না কেন, তার সাথে গল্প করবেন। কী গল্প? এই ধরেন বাড়ি কোথায়, কোথায় থাকেন, কীভাবে চলেন, পরিবারের লোকজন কত, ছেলে-মেয়েরা কী করে, মাসে কত টাকা থাকে, নামাজ পড়া হয় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে সারা রাস্তায় তাকে খুব আপন করে নিবেন। তাঁর সেই অভ্যাসটা এখন আমার ভেতরেও ঢুকে গেছে।

রিকশায় উঠে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি ‘গ্যারেজ কোথায়’? এরপর জানতে চাই, দেশের বাড়ি কোথায়? ঢাকা কীভাবে এসেছেন? ইত্যাদি।

একেকজনের একেক রকম উত্তর আমাকে খুব ভাবায়। মাঝে মধ্যে খুব প্রতিভাবান রিকশাচালকদের সাথে পরিচয় হয়। যিনি প্রতিভাবান, তার কথার মধ্যেও প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। তাকে সবসময় ‘এ প্লাস’ আর ‘ফাস্ট ক্লাস’ –এর সার্টিফিকেট ফাইলে করে ঘুরতে হয় না। অনেক রিকশাচালকের মাঝে প্রবল দেশপ্রেম লক্ষ করি। কারো মাঝে খুঁজে পাই অসাধারণ ভদ্রতা। কেউ কেউ এত ধার্মিক যে, তাদের দেখার পর নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জা হয়।

নীতি-নৈতিকতার কথা যদি বলেন, তাহলে বলব, তাদের নীতি-নৈতিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নীতি নির্ধারকদের চেয়েও অনেক ভালো। দু বেলা ভাত খেতে পারলেই তারা খুশি। দিনভর পরিশ্রম করে ঘাম ভেজা শরীরে বাসায় ফিরে এক মুঠো ভাত খেয়েও তারা খুব সুখী। তাদের দিকে তাকালে সুখের সংজ্ঞা পাল্টে যায়।

অবশ্য সবাই যে ভালো হয় তা নয়, তা বলছিও না, তা বলার প্রয়োজনও নেই। কারণ ভালো খারাপ সব জায়গাতেই আছে। কম আর বেশি, এই আর কী।

গতকাল এক রিকশায় করে অনেক দূর গিয়েছি। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ লোকটা কী উত্তর দিল তা বুঝতে পারছিলাম না। দুই তিন বার জিজ্ঞাসা করার পর আর জিজ্ঞাসা করি নি। তার কথা সামনের দিকের বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছিল।

লোকটার মুখে লম্বা দাড়ি। বয়স একটু বেশিই হবে। গন্তব্যে পৌঁছার পর আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, আপনার বাড়িটা যেন কোথায়?’ তিনি এর উত্তরে যা বললেন, তা আমাকে চমক লাগিয়ে দিল। তিনি বললেন, “আসল বাড়ি তো ভাই এই দুনিয়ায় না। এহানে তো কদিনের লাইগা আছি। কষ্ট-মষ্ট কইরা কাটায় গেলেই তো হইলো..”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে টাকাটা হাতে দিয়ে চলে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেক ভাবলাম। ভাবনার কথাই বটে। ঠিকই তো। আসল বাড়ি তো আমাদের এই দুনিয়া না..

নবীজীর (স.) সেই প্রসিদ্ধ বাণীটি মনে আছে না? তিনি যে বলেছিলেন,

‘পৃথিবীতে এমন ভাবে দিনাতিপাত কর যেন তুমি কোনো ভিনদেশী মুসাফির, বা, কোনো পথের পথিক”। (বুখারী: ৬০৫৩)

ভিনদেশী মুসাফির বলতে, যেন তুমি স্বদেশ থেকে অনেক দূরে থাক। যে দেশে থাক, তাতে চিরদিন থাকার উপায় নেই, অতএব তাকে স্বদেশে পরিণত করতে পারছ না। স্বদেশের ন্যায় বেশি লোকজনের সাথে তোমার পরিচয়ও নেই। ফলে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিরোধিতা, কপটতা-ভণ্ডামি, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি করার তেমন কোনো সুযোগই নেই। আবার অল্প দিন থাকবে বলে বেশি বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজনও তোমার নেই। আর পথিকের সম্বল তো মুসাফিরের চেয়েও কম। শুধু পথ চলতে যা প্রয়োজন, এক বোতল পানি, এক ব্যাগ খাবার... এই তো..

আল্লাহর উদাহরণ তো আরো চমৎকার। তিনি বলেন,

اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ

“তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়”। (৫৭:২০)

মূলতঃ, পরকালের প্রতি বিশ্বাস আর বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ই মানুষকে সব রকম অন্যায়-অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারে। আর পরকালের প্রতি অবিশ্বাস মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। ‘সব সুখ এই ষাট বছরের জীবনেই নিয়ে নিতে হবে’ –এই প্রবণতাই মানুষকে বিপথগামী করে।

রিকশাচালকের সেই কথাটা আমাকে এ পর্যন্ত ভাবাল। তাকে সালাম, তিনি আমাকে ভুলে যাওয়া অনেক মূল্যবান কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

এরকম আরো অনেক মূল্যবান বক্তব্য, অভিমত পাওয়া যায় রিকশাচালকদের কাছ থেকে। মাঝে মধ্যে খুব সুন্দর রাজনৈতিক মতামতও পাই। আর এ জন্যই তাদের সাথে গল্প করা।

আমরা অনেক সময়ই সমাজের এই শ্রেণীর মানুষের কোনো রকম মূল্যায়ন করি না। ‘মে দিবস’ আসলে তাদের নিয়ে দু চার কথা লিখি। ‘দিবস’ শেষে রাত্রি আসলেই আবার তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বাড়ি ফিরি।

এ প্রসঙ্গে আমার এক শিক্ষকের একটি বাণী মনে পড়ে গেল। মাঝে মধ্যে পড়া না পারলে তিনি বলতেন, লোহাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে কেমন শব্দ হয় শুনেছ? আমরা বলতাম, হ্যাঁ, খুব শুনেছি। টন টন টন টন। তিনি বলতেন, আরে না। তোমরা বুঝ নাই। শব্দটি হলো, ‘যেই, সেই, যেই, সেই’। মানে, লোহা বলে, আমাকে যতই আঘাত করো না কেন, আমি ঠিক যেই রকম ছিলাম, সেই রকমই থাকব। ভাঙব না। তো তোমরাও লোহার মতো হয়ে গেছ। এত করে বললেও তোমরা যেই ছিলে সেই থাক।

তো, আমরাও কেমন যেন ‘যেই-সেই’ মার্কা হয়ে গেছি। দিবস আসলে একটু হৈ চৈ, দিবস গেলে সব শেষ, আবার সেই আগের মতো।

সমাজের এই শ্রমিক শ্রেণীর সাথে আমাদের সবসময়ই ভালো ব্যবহার করা উচিৎ। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে, যদি কেউ সত্যিই শিখতে চায়। Really..

------------------------------
১লা মে ২০০৯, প্রথম আলো ব্লগ

0 comments:

Post a Comment

Welcome



Dear visitor, Please visit my new site: http://yousufsultan.com/