পড়ালেখার কোনো বয়স নাই রে!

-১-
সেদিন এক ইসলামী লাইব্রেরীতে বই কিনতে ও পড়তে গিয়েছিলাম। এই যে ‘সেদিন’ বললাম, এই ‘সেদিনের’ বয়সও কম করে তিন মাস হবে। তো, বই খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। তিনিও কী একটা বই খুঁজছিলেন। সম্ভবত কুরআন শরীফের ইংরেজী কোনো অনুবাদ কিনতে এসেছেন।

ভদ্রলোক যখন বইয়ের দাম পরিশোধ করছেন, তখন বিক্রেতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এসেছেন, কী করেন ইত্যাদি। তিনি বললেন, পেশায় তিনি ইঞ্জিনিয়ার। সম্প্রতি তিনি একটি নৈশ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছেন, যেখানে জেনারেল শিক্ষিতদেরকে কুরআন, হাদীস এবং প্রয়োজনীয় আরবি শেখানো হয়। যেন তারাও কুরআন-হাদীসের ইন-ডেপথ পড়াশোনা করতে পারেন আরবিতেই।

ভদ্রলোকের বয়স পঁয়ত্রিশ বা তার চেয়েও বেশি হবে। সপ্তাহে তিন দিন ক্লাশ। নিয়মিত আসেন তিনি। খুব আগ্রহ সহকারে পড়েন। সংসারে কোনো সমস্যা হয় কি না জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, পড়াশোনা তো নিজের কাছে। ওটা কোনো সমস্যা নয়।

-২-
সেদিন আরেক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়। এবারের ‘সেদিনের’ বয়স বেশি না। সর্বোচ্চ তিন দিন। ঘটনা হলো, আমি ক্লাশে বসে গল্প করছিলাম। ঘন্টাটা ফাঁকা ছিল। এর মধ্যে অন্য ক্লাশের একজন এসে বলে গেল, “ইঊসুফ ভাই, আপনার লোক এসেছে। ওখানে আছে...”। আমি তো অবাক। আমার লোক, তাও আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে হাজির! আজব! দৌঁড়ে গেলাম।

দেখি, দু’জন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। একজন ফর্সা করে, অপরজন একটু শ্যামলা। আমি সালাম দিলাম, হাত মেলালাম। কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন হচ্ছিল, এরা কারা? আমি নিজেই তো এদের চিনি না।
তাদের একজন বললেন, আপনি কি ইঊসুফ? আমি বললাম, জ্বি হা, কিন্তু আপনাদের তো চিনতে পারছি না। তিনি বললেন, “আমি অষ্ট্রেলিয়া থেকে এসেছি”। এতটুকু শোনার পর আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। একে তো চিনি না, দ্বিতীয়ত তিনি এসেছেন অন্য দেশ থেকে। আজব!

আমি কিছু একটা বলতে নিলে তিনি নিজেই বললেন, “আপনি যে সুন্নি ফোরামে লিখতেন....” এটুকু বলতেই বুঝে নিলাম যে তিনি সুন্নিফোরামের কোনো পাঠক/লেখক। সে সূত্র ধরেই দেখা করতে এসেছেন। আমার খুশি আর দেখে কে! ভার্চুয়াল পরিচয়ে কেউ যদি বাস্তবে দেখা করে, তা যে কত আনন্দের হয়!

তাড়াতাড়ি তাদেরকে রুমে এনে বসালাম। বন্ধুকে পাঠালাম কিছু আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। এরপর জানতে চাইলাম কীভাবে তিনি এখানে আসলেন, আমাকেই বা চিনেন কীভাবে?

তিনি একে একে বলত লাগলেন। এইচ.এস.সি পাশ করে তিনি অষ্ট্রেলিয়া গিয়েছেন। সেখানে অনার্স/মাষ্টার্স করে এখন তিনি ইঞ্জিনিয়ার। নয় বছর ধরে আছেন সেখানে। তাঁর বাসাটা মসজিদের খুব কাছে। সেই সুবাদে মসজিদের হুযুরদের সাথে তার উঠাবসা, ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা ইত্যাদি খুব বেশি। সাথে সাথে ইসলামী ওয়েব সাইটেও তিনি ঢুঁ মারেন। গত রমজান মাসে সুন্নী ফোরামে যখন আমি লিখতাম, তখন তিনিও পড়তেন। নতুন লিখতাম তাই একদিন এক ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম বাংলাদেশি বলে। তখন প্রায় ৫-১০ জন বাঙালী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে আমাকে অবাক করেছিলেন। তিনি সেটা পড়ে আমার নাম আর প্রতিষ্ঠানের নামটা মনে রেখেছিলেন।

এখন দেশে এসেছেন ইসলাম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করতে। চার মাসের জন্য তাবলীগেও এসেছেন। গতকালই মনে হয় সেটা শেষ হলো। জানালেন, তিনি কোনো ইসলামী কান্ট্রিতে চলে যেতে চান। সাউদীতে আসার খুব ইচ্ছে, হয়তো অচিরেই এসে পড়বেন।

কাকরাইল থেকে এক ভাইকে সাথে নিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। ভেবেছেন, আমাকে তো পাবেন না, ফোন নম্বরটা যদি পাওয়া যায়! কিন্তু আমাকেই পেয়ে যাওয়া তিনি খুব আনন্দিত। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। জানতে চাইলেন, এখন সেই ফোরামে লিখি কি না? আমি বললাম, না ভাই, বাংলা ব্লগ হওয়ায় এখন আর সেখানে তেমন যাওয়া হয় না।

তো, যা বলছিলাম, ওনার দেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ইসলাম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করা। বিশেষ করে আরবিটা ভালো করে জানা। তিনি বললেন, অনেকদিন তাবলীগ করে তিনি বু্ঝেছেন যে, সারা জীবন তাবলীগ করেও ইসলাম নিয়ে অনেকেরই কোনো পড়াশোনা হয় না। এটা একদম ঠিক নয়। বরং কুরআন-হাদীস না শিখতে পারলে সারাজীবন তাবলীগ করে লাভ কি!

শুধু এই চিন্তাকে পুঁজি করেই তিনি দেশে চলে এসেছেন। এখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন পরামর্শ নিতে, কী করা যায়, কোথায় পড়া যায় ইত্যাদি। আমি সবিনয়ে বললাম, ভাই, এখানে আমার অনেক শিক্ষক আছেন। আমি তো এখনো ছাত্র। তারা ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। কিন্তু না, তিনি আমার পরামর্শই নিবেন। আমিও তাঁকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়ার আশ্বাস দিলাম।

ভদ্রলোকের স্পৃহা দেখে আমি সত্যিই অবাক হলাম। তাঁর কথা হলো, “টাকা পয়সা এখন কোনো সমস্যা নয়। এখন আমি যখন-তখন অষ্ট্রেলিয়ায় যেতে পারি/ দেশে আসতে পারি। তাই আপাতত দেশে কোনো ছোট খাটো জব করার পাশাপাশি আরবি ও ইসলামী বিষয়াদিতে একাডেমিক পড়াশোনা করতে চাই। এরপর না হয় আবার চলে যাব”।

সবশেষে চা-নাস্তা করে তাঁকে বিদায় দিলাম। কিন্তু হৃদয় থেকে তাঁর স্মৃতিটুকু মুছে ফেলতে পারছি না। এসব শিক্ষানুরাগী মানুষগুলোর প্রতি আমার এত শ্রদ্ধা হয়, বলে বুঝাতে পারব না।

-৩-
আমার এক শিক্ষক সবসময় বলেন, “সারাজীবন পড়াশোনা করেও যদি ‘ছাত্র’ হতে পার, তাহলেই তুমি সার্থক। বিশেষজ্ঞ হওয়ার মাঝে গর্ব নেই, সত্যিকারের ‘ছাত্র’ হওয়ার মাঝেই গর্ব। বড়দের দেখবে, যে, তারা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বলেন, “আমি অর্থনীতির ছাত্র। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ইত্যাদি”। তারা এটা বলেন না যে, তারা অর্থনীতিবিদ বা অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ”। তাই ছাত্রত্বকে জিইয়ে রাখবে আজীবন, একদিন তাহলে অবশ্যই বড় হতে পারবে”।


সত্যি... কথাগুলো কত গভীর, তাই না?
যে দুজনের কথা বললাম, তাদের প্রতি রইল আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। দু’আ করি, তাদের স্পৃহা অটুট থাকুক, আল্লাহ তাদের সফলতার চূড়ায় পৌঁছে দিন। আমীন।

----------------------
২০শে মার্চ ২০০৯

0 comments:

Post a Comment

Welcome



Dear visitor, Please visit my new site: http://yousufsultan.com/