"ওরা বাউল ভাঙল, বলাকা ভাঙল; চেয়ে চেয়ে দেখলাম।" - সাম্প্রতিক ভাস্কর্য ইস্যুকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পর্যালোচনা

ওরা বাউল ভাঙল, বলাকা ভাঙল; চেয়ে চেয়ে দেখলাম। বিক্ষোভ চলেছে, অনশন হয়েছে, আমি দেখেই যাচ্ছি। আমার কি-ই বা করার আছে। কবিরা কবিতা লিখছে, লেখকরা প্রবন্ধ রচনা করছে, আমি নীরবে পড়ছি; আমার কি-ই বা লেখার আছে। কিন্তু এ সুযোগে কিছু ইসলাম বিদ্বেষী যে পুরো ইসলামকেই কটাক্ষ করছে; ইসলাম পড়ুয়াদের ঢালাওভাবে জঙ্গী বলছে, সন্ত্রাস বলছে; আমার কি সত্যিই কিছু বলার নেই? আমি কাঁদছি। চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। আজ নবীজী স: থাকলে এমন কিছু নিশ্চয় ঘটত না। এসব অবুঝরা ইসলামকে না জেনে না বুঝে এভাবে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারত না। আর এসব বুদ্ধিজীবিরাও ইসলামের অপব্যাখ্যা করতে পারত না।

আমরা মুসলিম। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের প্রভুর খুব সুন্দর একটি নাম সালাম। আমাদের পরস্পরের অভিবাদন সালাম। মুসলিম, ইসলাম, সালাম –প্রতিটিরই শব্দমূল سلم যার অর্থ শান্তি। যে ধর্মের নাম ‘শান্তি’, প্রভু ‘শান্তি’, তার অনুসারীরা ‘শান্তি’, পরস্পরের অভিবাদন ‘শান্তি’, সে ধর্ম কি সত্যিই এত অশান্তির শিক্ষা দেয়? আর সেই শান্তি ধর্মে দীক্ষিত শান্তি কর্মীরাই বা কিভাবে এত অশান্ত হতে পারে? এসব প্রশ্ন আমাকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। অবশেষে আজ লিখতে বসা।

গত ক’দিনের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ব্লগ পড়ে মনে হল, আমাদের মাঝে দু’ধরনের চিন্তাধারা কাজ করছে।
১. মূর্তি ও ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ।
২. মূর্তি ও ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ না। কাজেই দেশে যেসব ভাস্কর্য আছে সেসব ভেঙে ফেলতে হবে।

উল্লেখ্য যে, দুটো চিন্তাধারাই বিভ্রান্তিকর। তাই দুটো বিষয়েই ক্লিয়ার কাট আলোচনা করা হচ্ছে।

মূর্তি ও ভাস্কর্যের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান:

পাঠকবৃন্দ, প্রথমে নিম্নের আয়াত ও সহীহ হাদীসগুলোর উপর নজর বুলিয়ে নিন।

১. “তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা হতে বেঁচে থাক”। (সূরা হাজ্জ্ব:৩০)

২. আমর বিন আবাসা রা: বর্ণনা করেন, নবী স: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে। (মুসলিম:৮৩২)

৩. আব্দুল্লাহ বিন উমর রা: বলেন, নবী স: বলেছেন, “এই সব প্রতিকৃতির শিল্পীদের খুব শাস্তি দেয়া হবে। বলা হবে, তোমরা যা সৃষ্টি করেছ, তাতে প্রাণ দাও তো।” (বুখারী:২য় খন্ড, পৃ:৮৮০, মুসলিম:২য় খন্ড, পৃ:২০১, রশীদীয়া লাইব্রেরী দিল্লী) (বুখারী:৫৯৫১, মুসলিম:২১০৭)

৪. ইবনে আব্বাস রা: বলেন, আমি নবীজী স: কে বলতে শুনেছি যে, “যে কেউ দুনিয়াতে কোন প্রতিকৃতি তৈরি করবে তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে যেন সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে, অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।” (বুখারী:৫৯৬৩, মুসলিম:২১১০)

৫. আবু হুরায়রা রা: বলেন, “আমি নবীজীকে স: বলতে শুনেছি, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তার চেয়ে জালিম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির ন্যায় কিছু সৃষ্টি করে? পারলে একটি শস্য দানা বা একটি গম বা একটি যব সৃষ্টি করুক তো..।” (বুখারী:২:৮৮০, মুসলিম:২:২০২) (বুখারী:৫৯৫৩, মুসলিম:২১১১)

৬. আয়েশা রা: বলেন, “নবী স: ঘরে কোন ছবি-মূর্তি কিছু পেলে ছাড়তেন না, বরং তা সাথে সাথে ভেঙে ফেলতেন বা নষ্ট করে ফেলতেন।” (বুখারী:২:৮৮০,আবু দাউদ)

৭. আয়েশা রা: বলেন, “একবার তিনি একটা চাদর ক্রয় করেন, যাতে কিছু প্রাণীর ছবি ছিল। নবী স: তা দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন, ভিতরেও প্রবেশ করলেন না। আয়েশা রা: তাঁর চেহারায় ক্রোধের ছায়া দেখতে পেয়ে বললেন, নবীজী! আমার অপরাধ? নবী স: গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এ চাদরটি কেন? তিনি বললেন, এটা আমি আপনার জন্য কিনেছি। আপনি এতে বসবেন, শুবেন। নবী স: শুনে বললেন, কিয়ামতের দিন এসব প্রতিকৃতি ওয়ালাদের খুব শাস্তি দেয়া হবে। বলা হবে, এতে প্রাণ দাও। আর তা কখনোই সম্ভব হবে না। এরপর তিনি বললেন, যে ঘরে প্রতিকৃতি থাকে সে ঘরে ফিরিশতা প্রবেশ করে না।”(বুখারী:২:৮৮১, মুসলিম:২:২০১)

৮. আলী রা: বলেন, “একবার আমি নবী স: কে আমার ঘরে দাওয়াত করলাম। তিনি ঘরে এসে প্রাণীর প্রতিকৃতি দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন।” (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)

৯. আবু জুহায়ফা রা: বলেন, “নবী স: প্রতিকৃতি নির্মাণকারীদের কঠোর ভাষায় অভিসম্পাত করেছেন।” (বুখারী:২:৮৮১, আবু দাউদ)(বুখারী:৫৯৬২)

১০. আয়েশা রা: বলেন, “একদা নবী স: আমার ঘরে আসলেন। আমি তখন ছবি আছে এমন একটি চাদর আড়াল করে রাখছিলাম। নবীজীর স: চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি তা নিয়ে ছিড়ে ফেললেন। এরপর বললেন, কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশী শাস্তি তাদের হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য করে।” (বুখারী:২:৮৮০, মুসলিম:২:২০০)

এভাবে মোট বারো জন সাহাবী নবীজী স: হতে মানুষ ও জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি নির্মাণে নিষেধাজ্ঞার হাদীস বর্ণনা করেছেন। যার সবকটির মর্ম প্রায় একই রকম।

হাদীসগুলোতে একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিকৃতি নির্মাণকারীকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে এবং বলা হবে, যা বানিয়েছ তাতে প্রাণ দাও। আর সে তা কখনোই পারবে না। ফলে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য স্থাপনের ধৃষ্টতা প্রদর্শনের জন্য তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কারণ প্রাণ দিয়ে প্রাণী সৃষ্টি আল্লাহর একক উদ্ভাবন। তা অন্য কেউ সামান্য কপি করুক, তা আল্লাহ চান না। তিনি বলেন,

“তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, আকৃতি দানকারী।” (সূরা হাশর:২৪)

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের মাতৃগর্ভে যেমন ইচ্ছে তেমন আকৃতি দেন”। (সূরা আলে ইমরান:৬)

“আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তারপর তোমাদের আকৃতি দিয়েছি”। (সূরা আ’রাফ:১১)

তিনি এক, তার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিতে সর্বক্ষেত্রে “এক”-ই থাকতে চান। তিনি “মুতাকাব্বির” বা অহংকারী। অহংকার তাঁর গুণ, তা তো তাকেই মানায়। বান্দার এতে সামান্য প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই।

এসব হাদীসের ভিত্তিতেই প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা ইমাম নববী বলেন, এ ব্যাপারে হাদীস বিশারদগণ একমত যে রূহ বিশিষ্ট প্রাণীর প্রতিকৃতি বানানো নিষিদ্ধ এবং হারাম। (ফাতাওয়াল ইসলাম, প্রশ্ন নং:৭২২২ ও ২০৮৯৪, মাকতাবা শামেলা)

মিশরে ২০০৬ সনে সেখানকার মুফতীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে প্রাণীর মূর্তি/ ভাস্কর্যকে নিষিদ্ধ করা হয়। (খালিজ টাইমস, আরব আমিরাতের দুবাই হতে প্রকাশিত দৈনিক, ২০০৬)

কুয়েতেও আলিমদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ভাস্কর্যের অবৈধতা ঘোষণা করা হয়। (আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়াইতিয়্যাহ, কুয়েতের ইসলামী সমাধান সংকলন)

এছাড়া মক্কার সাবেক প্রধান খতীব ও প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (মৃত্যু: ১৪২১হি.) একই মত ব্যক্ত করেন। (শায়খ উসাইমিনের ফাতাওয়া সংকলন ‘লিকাউল বাবিল মাফতুহ’, প্রতিকৃতির বিধান)

সাউদীর সাবেক প্রধান মুফতী আব্দুল্লাহ বিন বায হতেও একই মত বর্ণিত আছে। (ফাতাওয়া ইবনে বায)

আসলে এতসব সহীহ হাদীস দ্বারা যখন কোন বিধান প্রমাণিত হয়, তখন মানবীয় যুক্তি দ্বারা তা পরিবর্তন করার কোন পথ থাকে না। আল্লাহ বলেন,

“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে ফয়সালা দেন, তখন সে ব্যপারে কোন মুমিন নর-নারীর আর কোন স্বাধীনতা থাকবে না। এরপরও যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে, সে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত হবে।”(সূরা আহযাব:৩৬)

“রাসূল তোমাদের যা নির্দেশ দেন তা কর, আর যা করতে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। নিশ্চয় আল্লাহর শাস্তি খুব কঠিন”। (সূরা হাশর:৭)

এদিকে কেউ কেউ কাবা শরীফে মাদার মেরির ছবি থাকার কথা বলে মূর্তির বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যা সম্পূর্ণই বানোয়াট। কেউ আবার ইসলামের বিধানে ইজতিহাদ বা কুরআন-হাদীস নির্ভর যুক্তির দ্বারা প্রাণীর মূর্তির বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইজতিহাদ তো কেবল সে ক্ষেত্রেই করা যায় যে ক্ষেত্রে কোন সুস্পষ্ট বিধান কুর’আন ও হাদীসে দেয়া হয়নি। (পড়ুন কাবা শরীফে মাদার মেরির ছবি: বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা)

সার কথা, প্রাণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য স্বয়ং মূর্তি ও ভাস্কর্য হিসেবেই নিষিদ্ধ। তা পূজোর জন্যই হোক আর সম্মান বা সৌন্দর্য্যের জন্যই হোক। বরং পূজোর জন্য হলে তো তার নিষেধাজ্ঞা কেবল এসব হাদীসের আলোকে নয়, বরং তাওহীদ বিরোধী ‘শিরক’ এ লিপ্ত হওয়ার কারণে। অতএব রূহ বিশিষ্ট প্রাণী তথা মানুষ ও পশু পাখি ছাড়া যত কিছুর প্রতিকৃতি/ভাস্কর্য/মূর্তি হতে পারে, সবই ইসলামে বৈধ।

রাষ্ট্রে অবস্থিত মূর্তি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে করণীয়:


প্রথম পর্বের আলোচনা দ্বারা তো এটা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হল যে প্রাণীর মূর্তি/ভাস্কর্য ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু তাই বলে যেসব ভাস্কর্য যুগ যুগ ধরে মানুষের শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাথে মিশে আছে সেগুলো কি ইসলাম ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেয়? এর উত্তর পেতে প্রথমে নিম্নের আয়াতগুলো পড়ুন।

১. “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারাও ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবষত আল্লাহকে মন্দ বলবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের কাজকর্ম সুশোভিত করে দিয়েছি। অতঃপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদেরকে বলে দিবেন যা কিছু তারা করত”। (সূরা আল-আন’আম:১০৮)

২. আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। (সূরা নাহল:১২৫)

৩. আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। (সূরা বাকারা:২০৫)

৪. আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা মায়েদা:৬৪, সূরা কাসাস:৭৭)

৫. এবং হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের পথে চলো না। (সূরা আ’রাফ:১৪২)

৬. এবং আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া:১০৭)

৭. অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল, হয়তো সে চিন্তাভাবনা করবে অথবা ভীত হবে। (সূরা ত্বাহা:৪৪)

প্রথম আয়াতটি দেখুন। এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টতই এমন কিছু করতে বা বলতে নিষেধ করছেন যাতে মানুষ না বুঝে উল্টো আল্লাহকে বা ইসলামকেই মন্দ বলে। এতে প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কুরআন যে বিভিন্ন আয়াতে কঠোর ভাষায় প্রতিমাদের অচেতন, অজ্ঞান, শক্তিহীন ও অসহায় হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছে? এর উত্তর হল যে, এসব ক্ষেত্রে বিতর্ক হিসেবে সত্য ফুটিয়ে তুলতে এভাবে বলা হয়েছে। যেন বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রই তাদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝে নিতে পারে এবং যারা বুঝতে পারে না তাদের ভ্রান্তি ও অদূরদর্শিতাও ফুটে ওঠে। এটা অনেকটা আদালতের সামনে সত্য বিবৃতি দেয়ার ন্যায় কিংবা ডাক্তারের সামনে রোগীর দোষ বর্ণনার ন্যায়।

এ আয়াত থেকে ফকীহগণ একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বের করেন। তা হল, যে কাজ নিজ সত্তার দিক দিয়ে বৈধ এবং কোন-না-কোন স্তরে প্রশংসনীয়ও বটে, কিন্তু সে কাজ করলে কোন ফাসাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে কিংবা তার ফলশ্রুতিতে মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে সে কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। উল্লিখিত আয়াতে মিথ্যা উপাস্য অর্থাৎ প্রতিমাদের মন্দ বলা ইমানী দায়িত্ব ও কমপক্ষে বৈধ মনে হলেও যদি সে ক্ষেত্রে এ আশংকা দেখা দেয় যে, প্রতিমা পূজারীরাও আল্লাহ তায়ালাকে মন্দ বলবে, তাহলে তখন এ বৈধ কাজটিও নিষেধ করা হয়েছে। (মাআ’রেফুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃ:৩৮৮-৩৯৭, মূল মাওলানা মুফতী শফী রহ:, অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত)

ইমাম বুখারী রহ: এ বিষয়ে একটা ভিন্ন অধ্যায়ই উল্লেখ করেছেন। যার শিরোনাম হল, “যে ব্যক্তি কোন পছন্দনীয় কাজ ছেড়ে দেয় এ আশংকায় যে, এতে হয়ত কেউ না বুঝে এর চেয়েও বড় কোন অপরাধে লিপ্ত হবে”। এ অধ্যায়ের অধীনে তিনি একটি হাদীস বর্ণনা করেন, যা একটি ঘটনার সার সংক্ষেপ।

ঘটনাটি হল, একবার রাসূলুল্লাহ স: হযরত আয়েশা রা: কে বললেন, “জাহিলিয়াত যুগে এক দুর্ঘটনায় কা’বাগৃহ বিধ্বস্ত হয়ে গেলে কুরায়শরা তার পূননির্মাণ করে। এ পুননির্মাণে কয়েকটি বিষয় প্রাচীন ইবরাহিমী ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। প্রথমত কাবার যে অংশকে বর্তমানে হাতীম বলা হয়, তাও কা’বাগৃহের অংশ-বিশেষ ছিল। কিন্তু অর্থাভাবে পূননির্মাণে সে অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত কা’বাগৃহের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দু’টি দরজা ছিল। একটি প্রবেশের, অপরটি প্রস্থানের। জাহিলিয়াত যুগে নির্মাতারা পশ্চিম দিকের দরজা বন্ধ করে একটি মাত্র দরজা রাখে। আর তাও ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চে স্থাপন করে, যাতে কা’বাগৃহে প্রবেশ কেবল তাদের ইচ্ছানুযায়ী হতে পারে। রাসূলুল্লাহ স: আরও বলেন, আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, কা’বাগৃহের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে সম্পূর্ণ-রূপে ইবরাহীম আ: এর নির্মাণের অনুরূপ করে দিই। কিন্তু আশংকা এই যে, তোমার সম্প্রদায় অর্থাৎ আরব জাতি তো নতুন নতুন মুসলমান হয়েছে। কা’বাগৃহ বিধ্বস্ত করলে তাদের মনে বিরূপ সন্দেহ দেখা দিতে পারে। তাই আমি আমার বাসনা মুলতবি রেখেছি”। (মাআ’রেফুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃ:৩৮৮-৩৯৭ এবং বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম, ৪৮ নং অধ্যায়)

তবে এ মূলনীতির ক্ষেত্রে শর্ত হল, যে বৈধ কাজটি নিষিদ্ধ করা হয়, তা যেন ইসলামের উদ্দিষ্ট ও জরুরী কাজসমূহের অন্তর্ভুক্ত না হয়। যেমন মিথ্যা উপাস্যদেরকে মন্দ বলা ও কা’বাগৃহকে ইবরাহীমী ভিত্তির অনুরূপ করা -এগুলোর উপর ইসলামের কোন উদ্দেশ্য নির্ভরশীল নয়। তাই এগুলোর কারণে যখন কোন ধর্মীয় অনিষ্টের আশংকা দেখা দেয়, তখন এগুলো পরিত্যক্ত হবে। আর যে কাজটি ইসলামী উদ্দেশ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত—ফরয, ওয়াজীব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ অথবা অন্য কোন প্রকার ইসলামী বৈশিষ্ট্য, তা করলে যদিও কিছু স্বল্পজ্ঞানী লোক ভুল বোঝাবুঝিতে লিপ্ত হয়, তবু এ কাজ কখনও ত্যাগ করা যাবে না। বরং অন্য পন্থায় তাদের ভুল বোঝাবুঝি ও ভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করা হবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফের মুশরিকদের মন্দ বলা সত্ত্বেও মুসলমানদের নামায না ছাড়া এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। (প্রাগুক্ত)

সার কথা, যে কাজ ইসলামী উদ্দেশ্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত তা কখনো ত্যাগ করা যাবে না। আর যে কাজ ইসলামী উদ্দেশ্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং যা ত্যাগ করলে কোন ধর্মীয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় না, এ ধরনের কাজ অপরের ভুল বোঝাবুঝি অথবা ভ্রান্তির আশংকার কারণে পরিত্যাগ করা যাবে। (আরো বিস্তারিত পড়ুন -মাআ’রেফুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃ:৩৮৮-৩৯৭, মূল মাওলানা মুফতী শফী রহ:, অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত)

অন্য আয়াতগুলো দেখুন। আল্লাহ বলছেন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে বুঝিয়ে শুনিয়ে, উত্তম পন্থায় ও উৎকৃষ্ট আচরণের দ্বারা। দাঙ্গা হাঙ্গামা তিনি কখনো পছন্দ করেন না। নবীজী স: কে তিনি পাঠিয়েছেনই এসব দাঙ্গা হাঙ্গামার অবসান ঘটাতে, বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বানিয়ে।

অতএব যে ভাস্কর্যের সাথে মানুষের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি ও চেতনা জড়িয়ে আছে, এভাবে রাতের আধারে গিয়ে তা ভাঙা কখনোই ইসলাম সমর্থিত পথ নয়। বরং এটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা, জ্ঞানহীনতা, অসতর্কতা এবং ইসলামকে ভুল ভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে কেউ যদি তাতে রাজনৈতিক গন্ধ পায় তাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সমাজের সর্বস্তরে শান্তি বজায় রাখতে ইসলাম সর্বদা সর্বোচ্চ নির্দেশ দিয়েছে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, মুসলিম-অমুসলিম সকলের সাথে ভাল ব্যবহার করাই ইসলামের আদর্শ। সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কখনোই ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না।

আর এয়ারপোর্টের সামনে যা ঘটেছে তা নিতান্তই উসকানি ছিল বলে মনে হয়। সরকারকে তাই এমন পরিণতি দেখতেই হয়েছে। মাদ্রাসা ছাত্রদের এহেন ভূমিকা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রত্যেক বিবাদেরই শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে, এখানেও তা হতে পারত। কিন্তু সরকার নিজেই যখন জনগণের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে, তখন জনগণ এর জবাবে সেন্টিমেন্ট তো হবেই; আমরা তখন কাকে দোষারোপ করতে পারি?

কারো সংস্কৃতিতে আঘাত হানা যেমন কাম্য নয়, তেমনি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত হানা কাম্য নয়। কেনই বা সেখানে বাউল হবে, আর কেনই বা সেখানে হজ্জ্ব মিনার হবে? অত্যাধুনিক ফোয়ারা বা অন্যকিছু হলে খারাপ কি হত? এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ্য মানুষ মুসলিম, এ কথা কখনোই ভুলে যাওয়া রাখা উচিৎ নয়। (দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ২ এর ক অনুচ্ছেদ)

সবশেষে পুরো আর্টিকেলটার মূল কথাগুলো তুলে ধরছি।

১. মূর্তি ও ভাস্কর্য, পূজো ও সৌন্দর্য্য -এসব বিভাজন ছাড়াই ইসলামে প্রাণীর যে কোন প্রকার প্রতিকৃতিই নিষিদ্ধ। তা অস্বীকার করলে কুরআন ও হাদীসের বিধানে ‘তাহরীফ’ বা অবৈধ পরিবর্তন বলে গণ্য হবে।

২. তবে বলাকা বা অন্য যে কোন ভাস্কর্য এভাবে ভাঙা ইসলাম সম্মত নয়। বরং তা নিশ্চিতভাবেই মানুষের সামনে ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার নামান্তর কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর কোন চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ। বাউল ভাস্কর্যও এভাবে ভাঙা ঠিক হয়নি। তবে তা এভাবে বানানোও উচিৎ হয়নি।

বি:দ্র: লেখাটাকে যথাসম্ভব অথেনটিক করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে। আবার সংক্ষিপ্ত করার প্রতিও বিশেষ লক্ষ রাখতে হয়েছে। নতুন লেখক বলে ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে। তবে তথ্যগত কোন ভুল না থাকার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আরো বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য দেখতে পারেন আমার তথ্যপুঞ্জি:
১. আল-কুরআন
২. সহীহ বুখারী, রশীদিয়া লাইব্ররী, দিল্লী
৩. সহীহ মুসলিম, রশীদিয়া লাইব্ররী, দিল্লী
৩. সুনানে তিরমিযী, রশীদিয়া লাইব্ররী, দিল্লী
৪. সুনানে আবু দাউদ, রশীদিয়া লাইব্ররী, দিল্লী
৫. মিরকাত শরহে মিশকাত, মোল্লা আলী আল কারী রহ:, মাকতাবা শামেলা
৬. তাহরীমুত তাসউইর, একটি প্রবন্ধ, মাকতাবা শামেলা
৭. মাআরেফুল কুরআন –বাংলা, সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
৮. ফাতাওয়াল ইসলাম, মাকতাবা শামেলা
৯. লিকাউল বাবিল মাফতুহ, শায়খ উসাইমিনে ফাত্‌ওয়া সমগ্র, মাকতাবা শামেলা
১০. ফাতাওয়াল আযহার, আল আযহার ইউনিভার্সিটি কর্তৃক প্রদত্ত ফাত্‌ওয়ার সংকলন, মাকতাবা শামেলা
১১. ফাতাওয়াশ শাবাকাতিল ইসলামিয়া, মাকতাবা শামেলা
১২. মাকতাবা শামেলা, ডিজিটাল ইসলামী লাইব্রেরী
১৩. আল কাউসার, ডিসেম্বর ২০০৮ সংখ্যা, মারকাযুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া হতে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. আজব ভাই ও আরো অনেক সহব্লগার, যাদের লেখার প্রেক্ষিতেই এ লেখার জন্ম।
২. আমার প্রিয় দু’জন শিক্ষক, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহয়া সাহেব এবং আবু সাবের আব্দুল্লাহ সাহেব, যাদের সাথে আলোচনায় আমার অনেক বিষয় ক্লিয়ার হয়েছে।
৩. অপর শিক্ষক, আরীফুদ্দীন মারূফ সাহেব, যার মুখে ইসলামের এতসুন্দর ব্যাখ্যাটা শুনেছিলাম। (যা আমি দ্বিতীয় প্যারায় উল্লেখ করেছি।)
আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ম্যাসেজ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার তাওফীক দিন, আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন। সুম্মা আমীন।

প্রথম প্রকাশ ৫ই ডিসেম্বর ২০০৮, প্রথম আলো ব্লগে

0 comments:

Post a Comment

Welcome



Dear visitor, Please visit my new site: http://yousufsultan.com/