মূর্তি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা : বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা

সম্প্রতি কল্পকথার গল্পে বিভোর হুমায়ুন আহমেদের লেখা থেকে (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর) জনমনে একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আমি প্রথমে সে অংশটুকু উদ্ধৃত করছি। “আমাদের মহানবী (স: ) কাবা শরিফের ৩৬০ টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে। যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজী স: সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘এই ছবিটা তোমরা নষ্ট করো না’। কাজটা তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। মহানবীর স: ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরীফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিল। এতে কাবা শরিফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুন্ন হয়নি। মহানবীর স: প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের (আরব ইতিহাসবিদ, জন্ম: ৭০৪ খৃষ্টাব্দ মদিনা, মৃত্য: ৭৬৭ খৃষ্টাব্দ বাগদাদ) লেখা দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বললাম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আলফ্রেড গিয়োম (প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৫২)”

আলফ্রেড অনূদিত ‘দি লাইফ অব মুহাম্মদ’ গ্রন্থটি খৃষ্টান লোকদের নবীবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বৈ কিছুই নয়। হুমায়ুন আহমেদ সেই রচনাকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে খৃষ্টানদের ইসলামের নবীবিদ্বেষী লেখাকে তিনি বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া কিভাবে গ্রহণ করলেন?

প্রথমে ইবনে ইসহাক সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। তিনি রাসূলুল্লাহর স: প্রথম জীবনীকার। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনেক লেখালেখি করে গিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কোনটিই আজ অবশিষ্ট নেই। তার মৃত্যুর পর তার ছাত্র ‘বাক্কাকী’ তার কাজগুলো সম্পাদনা করে আবার লিখেন। কিন্তু সেগুলোও পরে নষ্ট হয়ে যায়। পরে বাক্কাকীর ছাত্র ‘ইবনে হিশাম’ তা পুনরায় সম্পাদনা করে নবীজীর স: জীবনী গ্রন্থ লিখেন, যা আজো ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’ নামে আমাদের কাছে আছে। ইবনে ইসহাকের অপর এক ছাত্র ‘সালামা ইবনে ফজল’। তিনিও বাক্কাকীর ন্যায় ইবনে ইসহাকের কাজগুলো সম্পাদনা করেন। কিন্তু কালক্রমে তাও হারিয়ে যায়। এরপর সালামার ছাত্র ‘ইবনে জারীর তাবারী’ তা পুণরায় সম্পাদনা করেন। তার সম্পাদনাটি বর্তমানে ‘তারীখে তাবারী’ নামে আমাদের হাতে আছে। ইবনে হিশাম আর তাবারীর রচনার মাঝে পার্থক্য হল, ইবনে হিশাম তার সম্পাদনাকালে ইবনে ইসহাকের ভিত্তিহীন বর্ণনাগুলো বাদ দিয়েছেন এবং আরো কিছু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা যোগ করেছেন। আর তাবারী ইবনে ইসহাকের অধিকাংশ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন এবং নিজেও অনেক বর্ণনা যোগ করেছেন। এতে তিনি ইবনে হিশামের মত এত সতর্কতা অবলম্বন করেননি। আলফ্রেড গিয়োম ১৯৫৫ সালে তাবারী ও ইবনে হিশাম থেকে কেবল ইবনে ইসহাকের বর্ণনাগুলো সংকলন করে দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থটি লিখেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তা ২০০৩ ও ২০০৬ এ পুণ:মুদ্রিত হয়। (উইকিপিডিয়া অনলাইন)

এবার আসা যাক কাবা শরিফের ভেতর মাদার মেরির ছবি প্রসঙ্গে। ইবনে ইসহাকের জীবনী গ্রন্থের দুই ধারক তাবারী ও ইবনে হিশাম কেউই এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেন নি। এ দুটো জীবনী গ্রন্থ ছাড়াও প্রসিদ্ধ-অপ্রসিদ্ধ কোন জীবনী গ্রন্থেই এর উল্লেখ নেই। তাহলে প্রশ্ন, আলফ্রেড গিয়োম তা পেলেন কোথা থেকে? ‘আখবারে মাক্কা’ নামে ‘আযরাকী’ রচিত এক ইতিহাস গ্রন্থ হতে এ বর্ণনা পাওয়া যায়। আলফ্রেড গিয়োম সেখান থেকে তা নিজে সংযোজন করেছেন,এটা ইবনে ইসহাকের কোন বর্ণনা নয়।

আর ‘আখবারে মাক্কা’..?। আল্লামা আব্দুর রহমান বিন ইয়াহয়া মুয়াল্লিমী (মৃত্যু: ১৩৮৬ হি: ) তার মাকামে ইব্রাহীম কিতাবে এ বর্ণনাটি উল্লেখ করে বলেন, “আযরাকী তো নিজের ব্যাপারেই নির্ভরযোগ্য নয়। কোন ইমাম তাকে নির্ভরযোগ্য বলেননি। ইমাম বুখারী, ইবনে আবি হাতিম, কেউই তার বর্ণনা আনেননি। বরং “আল ইকদুস সামীন” গ্রন্থে গ্রন্থকার তার জীবনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, আমি কাউকে তার জীবনী উল্লেখ করতে পাইনি। অতএব সে হাদীস বিশারদদের নিয়মানুসারে ‘মাজহুল’, যার পরিচয় অজ্ঞাত।” (মাকামে ইব্রাহীম, পৃ:৫৬) সুতরাং, তার কথা নির্ভরযোগ্য নয়।

এখন যে বর্ণনা নিয়ে এত হট্যগোল সে প্রসঙ্গে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আযরাকী উক্ত বর্ণনা চারটি সুত্রে বর্ণনা করেন। যার প্রতিটিই বিচ্ছিন্ন সুত্র, অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ও গোজামিল বক্তব্য থাকায় হাদীস বিশারদদের কাছে একেবারেই গ্রহণ যোগ্য নয়। এর বিপরীতে জাবের রাঃ বর্ণনা করেন, “মক্কা বিজয়ের দিন নবী (সাঃ) ওমর (রাঃ) কে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি কাবা শরিফের ভিতরের সব ছবি নষ্ট করে দেন। অতঃপর ছবি নষ্ট করার আগে নবী (সাঃ) কাবা শরিফের ভিতর প্রবেশ করেন নি। (আবু দাউদ, বায়হাকী, আহমদ) এছাড়া আযরাকীর উক্ত বর্ণনা টা বুখারী তে এভাবে এসেছে, “নবী (সাঃ) যখন কাবা শরিফের কাছে আসলেন, তখন তিনি তাতে মূর্তি থাকাবস্থায় প্রবেশ করতে সংকোচ করলেন। এরপর তিনি নির্দেশ দিলে সেগুলো বের করা হল। তখন সেখানে ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আঃ) এর মূর্তিও ছিল, তাদের হাতে ভাগ্য নির্ধারণী তীর ছিল। নবীজী (সাঃ) তা দেখে বললেন, আল্লাহ তাদের (যারা এগুলো বানিয়েছে) ধ্বংস করুন। তারা কি জানত না যে, ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আঃ) কখনো এসব ভাগ্য নির্ধারণী তীর ব্যবহার করেননি? এরপর তিনি কাবা শরিফে প্রবেশ করলেন এবং চতুর্দিকে তাকবীর ধ্বনি দিলেন, তবে তাতে কোন নামাজ পড়লেন না। (বুখারীঃ ১:২১৮, আবু দাউদ:১:২৭৭, রশীদিয়া লাইব্রেরী দিল্লী) এভাবে হাদিসের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবেও এসেছে। এর পরের যে অংশটুকু আযরাকী বর্ণনা করেন যে, নবীজী (সাঃ) ঈসা ও মরিয়ম (আঃ)-এর ছবি নষ্ট করতে নিষেধ করেন, তা কেউ বর্ণনা করেন নি। এটি সম্পূর্ণই বানোয়াট।

এ প্রসঙ্গে আরো কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা যেতে পারে- উসামা বিন যায়দ (রাঃ) বলেন, আমি নবীজীর (সাঃ) সাথে কাবা শরিফের ভিতর প্রবেশ করলাম। তিনি তাতে কিছু ছবি দেখতে পেলেন। তখন তিনি এক বালতি পানি আনতে বললেন। আমি আনলাম। এরপর তিনি তা দিয়ে সেগুলো মুছে দিলেন এবং বললেন, “আল্লাহ ঐ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করুন, যারা এমন জিনিসের আকৃতি দেয় যা তারা সৃষ্টি করতে পারবে না”। (আবু দাউদ) এ হাদিস অনুসারে নবীজী (সাঃ) স্পষ্টতই সব ছবি নষ্ট করেন এবং এতে ঈসা ও মরিয়ম (আঃ)-এর আকৃতি অক্ষুন্ন থাকার কোন প্রমাণ নেই। অপর বর্ণনায় আছে, “ওমর (রাঃ) কাবার ভেতরে ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) এর মূর্তি দুটো প্রথমে নষ্ট করেননি। নবীজী (সাঃ) ভেতরে ঢুকে তা দেখে বললেন, ওমর, আমি কি তোমাকে বলিনি যে, ভেতরে কোন মূর্তি বা ছবি রাখবে না। আল্লাহ তায়ালা এর নির্মাতাদের ধ্বংস করুন। এরপর তিনি মরিয়ম (মেরি)-এর ছবি দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এখানে যত ছবি আছে সব মুছে দাও। আল্লাহ ঐ সম্প্রদায় কে ধ্বংস করুন যারা এমন কিছুর আকৃতি দেয়, যা তারা সৃষ্টি করতে পারে না। (ওয়াকিদী)

বলতে পারি আমরা স্পষ্টতই বলব, কাজটা যে নবী (সাঃ) সৌন্দর্য্যরে প্রতি তাঁর অসীম মমতাবোধ থেকে করেছেন, তাতো স্পষ্ট নয়। আযরাকীও তো এ কথা বর্ণনা করেননি। তাহলে কি তা জাল হাদীসের মাঝে মনগড়া সংযোজন নয়? এভাবে একটা দুর্বল, বানোয়াট, জাল ও ভিত্তিহীন হাদীসের ভিত্তিতে ইসলামে এত বড় বিভ্রান্তি ছড়ানো কি ঠিক? ছবি ও মূর্তি হারাম হওয়ার ব্যপারে নবীজী (সাঃ) এর অসংখ্য বর্ণনা, যার কিছু আমরা উল্লেখ করেছি, এর বিপরীতে এই দুর্বল বর্ণনা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এটা কি নাটক-উপন্যাসের মত ইসলামের স্পর্শকাতর বিধানে অসতর্ক হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস নয়? আর ভাস্কর্য তো সর্বকালের সকল ইমামদের মতেই নিষিদ্ধ, কোনরূপ দ্বিমত নেই তাতে। এছাড়া ছবির বর্ণনা দিয়ে ভাস্কর্যের বৈধতার প্রমাণই বা হয় কিভাবে? কাবা শরিফে পূজোর মূর্তি ধ্বংস করার পরও ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) এর দুটো মূর্তি ছিল। যেগুলো পূজোর নয়, বরং আরবরা তা ভাগ্য নির্ধারণে ব্যবহার করত। সেগুলো তাদের জন্য মডেল ও সৌন্দর্য্যরে প্রতীক ছিল। কিন্তু আফসোস! সৌন্দর্য্যরে প্রতি অসীম মমতা যে নবীর (সাঃ), তিনি নিজেই সেগুলো নির্মমভাবে ভাঙতে নির্দেশ দিলেন। আবার সাথে সাথে জোর কণ্ঠে এও বললেন, “আল্লাহ এর নির্মাতাদের ধ্বংস করুন”। আমার মনে হয়, হুমায়ুন সাহেবের নজরে মূর্তির এই হাদিসটি আসেনি। কিন্তু এতসব ‘ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার’র মাঝে কি ইসলামের ব্যাপারে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও সতর্কহীনতাই ফুটে উঠে না? নাকি এটা ‘বড় বড় লেখকের চরম ভুল’। সে যাই হোক, একটা কথা না বললেই নয়, হুমায়ুন সাহেব কিন্তু নবীজীর (সাঃ) ফুল-প্রীতির হাদিস দিয়েই তাঁর সৌন্দর্য্য প্রীতির প্রমাণ দিতে পারতেন। খুঁজে খুঁজে এই জাল হাদীস উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন ছিল না।

তবে যেগুলো অসম্পূর্ণ, শুধু একটি হাত, বা পা ইত্যাদি, সেগুলো হারাম নয়। আয়েশা (রা: ) এর পুতুলটি এমনি ছিল। তা মূলত একটি কাপড়ের দলা ছিল, যাকে তিনি পুতুল বলে উল্লেখ করেছেন। নবীজী (সাঃ) এটাকে নিছক কাপড়ের দলা দেখেই প্রশ্ন করেছেন, আয়েশা! এটা কি? অন্যথায় সম্পূর্ণ পুতুল হলে প্রশ্ন করার প্রয়োজনই পড়ত না। আর এটাকে আয়েশা (রাঃ) সুলায়মান (আঃ) এর ঘোড়ার ন্যায় ঘোড়ার পুতুল বলাতেই নবীজী (সাঃ) হেসে মজা করেছেন। এ কথাটুকুই হুমায়ুন সাহেবের ভাষায়, “আমরা সবাই জানি, হযরত আয়েশা (রাঃ) নয় বছর বয়সে নবীজীর (সাঃ) সহধর্মিনী হন। তিনি পুতুল নিয়ে খেলতেন। নবীজীর তাতে কোন আপত্তি ছিল না, বরং তিনিও মজা পেতেন এবং কৌতূহল প্রদর্শন করতেন।” নবীজীর আপত্তি ছিল না কারণ তা ছিল অসম্পূর্ণ। আর এটাকে আয়েশা (রাঃ) ঘোড়া বলে উল্লেখ করায় তাঁর শিশুসুলভ আচরণে নবীজী (সাঃ) হাসেন।

সারকথা, ইসলাম মূর্তিকে অনুমোদন করে না। তা উপাসনার জন্যই হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক।

হুমায়ুন সাহেব ইরান ও লিবিয়ায় এবং শেখ সাদী ও শেখ ফরিদদুদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর মাজারের সামনে ভাস্কর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। কোথায় কি ভাস্কর্য আছে তা ইসলামের দলিল নয়। দলিল হলো কোরআন ও হাদিস।

------------------------------------------
প্রথম প্রকাশ: ইনকিলাব > ১২ই নভেম্বর > ফিচার > আদিগন্ত > পৃষ্ঠা নং: ৪-৭
দ্বিতীয় প্রকাশ: প্রথম আলো ব্লগ

0 comments:

Post a Comment

Welcome



Dear visitor, Please visit my new site: http://yousufsultan.com/